নবম-দশম শ্রেণির পড়াশোনা রসায়ন: জারণ বিজারণ বিক্রিয়া
আচ্ছা , রাসায়নিক বিক্রিয়া কি আমরা জানি তো ? না , জানার কোনই কারন নাই ।
এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকে আসলে কতগুলো দিক থেকে ভাগ করা যায় । এর মাঝে ইলেকট্রন স্থানান্তরের উপরে ভিত্তি করেও আমরা রাসায়নিক বিক্রিয়ার শ্রেণি বিন্যাস করতে পারি ।
যাই হোক ইলেকট্রন স্থানান্তরের উপরে ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়া দুই প্রকার ।
১। প্রথম দল বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন স্থানান্তর হয়।
২। ২য় দল বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন স্থানান্তর হয় না ।
যেই বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন স্থানান্তর হয় তাকে বলা হয় রেডক্স বিক্রিয়া । ইংরেজিতে এই নামে ডাকা হয় । যদিও বাংলাটা হচ্ছে জারন-বিজারন বিক্রিয়া । প্রথমে একটা কথা ক্লিয়ার করে নেই , কেমন ?
সেটা হচ্ছে , জারণ-বিজারন কিন্তু একই বিক্রিয়া । আলাদা কোন বিক্রিয়া না । জারণ আবার বিজারণ দেখে অনেকে মনে করতে পারে এরা মনে হয় আলাদা আলাদা বিক্রিয়া , কিন্তু এরা আসলে একই বিক্রিয়া । কি করে তারা একই বিক্রিয়া হয় একটু শুনি তো ?
জারণ হচ্ছে ইলেকট্রন বর্জন করা ।
আর বিজারণ হচ্ছে ইলেকট্রন গ্রহণ করা ।
( এখন থেকে আমরা ইলেকট্রন বর্জন করাকে জারণ আর গ্রহণ করাকে বিজারণ বলটে শিখব )
ধরা যাক কোন একটা বিক্রিয়ায় একটা মৌল ইলেকট্রন বর্জন করবে । কেউ যদি ইলেকট্রন বর্জন করে তাহলে অবশ্যই অন্য কাউকে সেই ইলেকট্রনটা গ্রহণ করতে হবে । অর্থাৎ বিক্রিয়ার অন্য কোন মৌল হয়ত সেই ইলেকট্রনটা গ্রহণ করবে ।
এখানে কি আমরা একটা জিনিস খেয়াল করেছি ? একটা মৌল ইলেকট্রন বর্জন করেছে আর আরেকটা মৌল ইলেকট্রন গ্রহণ করেছে ।ইলেকট্রন বর্জনকে আমরা একটু আগে বলেছি জারণ , আর গ্রহণ করাকে বলেছি বিজারণ । তাহলে তো আমরা খুব সহজেই একে জারণ বিজারণ বিক্রিয়া বলতে পারি । কারন এখানে গ্রহণ বর্জন ২ টাই হয়েছে ।
এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি , চোখ বড় বড় করে পড় – জারণ – বিজারণ আসলে একই বিক্রিয়ার দুইটা ধাপ । এরা নিজেরা আলাদাভাবে কোন বিক্রিয়া হতে পারে না । কেউ যদি ইলেকট্রন ত্যাগ করে কিন্তু সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করার জন্য অন্য কোন মৌল যদি না ই থাকে তবে কি সেটাকে রাসায়নিক বিক্রিয়া বলা যায় ? আমরা তো জানি রাসায়নিক বিক্রিয়া দুইটা পদার্থের মাঝে মিথস্ক্রিয়া । এখানে কি কেউ কার সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পেরেছে ? পারে নি । হুদা কামেই একটা মৌল ইলেকট্রন ত্যাগ করে বসে আছে । এই ইলেকট্রন ত্যাগই হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এই ইলেকট্রন কেউ গ্রহণ করে নি , তাই রাসায়নিক বিক্রিয়াও হয় নি । এই জারণের সাথে যদি বিজারণটাও যুক্ত হত অর্থাৎ অন্য কোন মৌল সেই ইলেকট্রনটা গ্রহণ করত তবেই তো বিক্রিয়া হত ।
প্রেমের সম্পর্ক = রাসায়নিক বিক্রিয়া ।
প্রপোজ= ইলেকট্রন
এটাকে অনেকটা প্রেমের সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায় । ছেলে যদি মেয়েকে প্রপোজ করে তাহলেই কিন্তু প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় নি । মেয়ে যদি সেই প্রপোজ গ্রহণ করে তবেই প্রেমের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হবে। তাই আমরা বলতে পারি শুধু জারণ হলে কিছু হবে না , জারণ বিজারণ দুইটা হলেই দুইটা পদার্থের মাঝে একটা মিথস্ক্রিয়া হবে যাকে আমরা রাসায়নিক বিক্রিয়া বলতে পারি ( কেউ যেন আবার এটাকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সার্বজনীন সংজ্ঞা মনে না করে ) ।
ইলেকট্রন স্থানান্তরের মাধ্যমে সঙ্ঘটিত বিক্রিয়ার অপর নাম আমরা বলতে পারি – ” জারন-বিজারন বিক্রিয়া ”
” জারন-বিজারন বিক্রিয়া ” কি সেটা বলার আগে আরেকটা জিনিস বলে নেই ,
যে ইলেকট্রন গ্রহণ করে সে জারক ।
আর যে ইলেকট্রন বর্জন করে সে বিজারক ।
এখানে নামগুলাই আসলে পেচগি লাগায় । ইলেকট্রন গ্রহণ করাকে যদি বিজারণ বলা হয় তবে যে ইলেকট্রন গ্রহণ করবে তাকেই তো বিজারক বলা উচিত । কিন্তু এখানে তা না , বরং বিজ্ঞানীরা নামের ক্ষেত্রে উলটাপালটা প্যাচ লাগাইয়াছে । যাই হোক , কি আর করার , তাদের কথাই মানতে হবে।
এবার জারণ – বিজারণ বিক্রিয়ায় আসা যাক ।
আমরা একটা উদাহরণের মাধ্যমে জারণ বিজারণ বিক্রিয়াটা ব্যাখ্যা করতে পারি –
Zn +CuSO4 = ZnSO4 + Cu ……………(1)
(এক্ষেত্রে নবম-দশম শ্রেণির বইয়ের চিত্রটি দেখা যেতে পারে )
এখানে জিঙ্ক আর কপার সালফেট বিক্রিয়া করে জিঙ্ক সালফেট আর কপার উৎপন্ন করেছে । আমরা বলছি এটা একটা জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া । তার মানে অবশ্যই এখানে ইলেকট্রন আদান- প্রদান বা গ্রহণ বর্জন সম্পন্ন হয়েছে । তাই তো ?
এখন আমরা দেখতে চাই কিভাবে এই বিক্রিয়াটি জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ।
Zn বাবাজি বিক্রিয়ক হিসেবে খালি পরে আছে । আর অন্যদিকে CuSO4 একটি যৌগ আকারে রয়েছে । যেই যৌগ Cu আর SO4 দিয়ে গঠিত । কিভাবে কপার সালফেট তৈরি হয়েছে সেটা যদি বলি তবে বলতে হবে কপার একটি ইলেকট্রন সালফেট কে দিয়েছে আর সালফেট, কপার থেকে একটি ইলেকট্রন নিয়েছে , দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে তাদের রাসায়নিক প্রেমের সম্পর্ক । এই সম্পর্কে কপার ধনাত্মক আধানে আহিত আর সালফেট ঋণাত্মক আধানে । উভয়ে মিলে কপার সালফেটের ধনাত্মক ঋণাত্মক কাটাকাটি করে মোট আধান হয় শুন্য ।
এখন আমরা যখন জিঙ্ক আর কপার সালফেট কে একত্রিত করি তখন আসলে কি হয় ?
তখন আসলে জিঙ্ক একটা ইলেকট্রন ত্যাগ করে । যেটা ‘জারণ-বিজারণ’ বিক্রিয়ার প্রথম অংশ যেখানে শুধু মাত্র জারণ সম্পন্ন হয়েছে । এখন জিঙ্ক যদি ইলেকট্রন ত্যাগ করে তবে সে নিশ্চিতভাবেই ধনাত্মক আয়নে পরিণত হবে । আর অন্যদিকে কপার সালফেটের , কপার মৌলটি আগে থেকেই ধনাত্মকভাবে আহিত অবস্থায় রয়েছে । সে জিঙ্কের ত্যাগ করা ইলেকট্রনটি গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় হবে । এটা হচ্ছে ‘জারণ-বিজারণ’ বিক্রিয়ার দ্বিতীয় বা শেষ অংশ যেখানে আসলে বিজারণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে (মানে কারো দ্বারা ইলেকট্রন গ্রহিত হয়েছে ) । আর অন্য দিকে কপার সালফেট থেকে কপার আলাদা হয়ে গেলে বাকি পরে থাকে ঋণাত্মকভাবে আহিত সালফেট । এই সালফেট তখন ধনাত্মক জিঙ্কের সাথে বিক্রিয়া করে জিঙ্ক সালফেট উৎপন্ন করবে ।
এই বিক্রিয়ায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি ইলেকট্রন গ্রহণ বর্জন হয়েছে । তাই এই বিক্রিয়াকে আমরা জারন-বিজারন বিক্রিয়া বলতে পারি ।
কিভাবে ইলেকট্রন গ্রহণ বর্জন হল ?
ওই যে , জিঙ্ক প্রথমে একটা ইলেকট্রন বর্জন করল। তারপরে কপার সালফেটের , কপার সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করল । এরপরে কপার ইলেকট্রন নিয়ে আলাদা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল । আর অন্যদিকে জিঙ্ক , সালফেটের সাথে যুক্ত হল ।
এই হচ্ছে আমাদের জারণ বিজারণ বিক্রিয়া ।
এবার বলি জারণ সংখ্যা কি ?
এই যে একটু আগে আমরা দেখলাম জিঙ্ক একটা ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আধানে পরিণত হয়েছে । আবার কিছু কিছু মৌলের ক্ষেত্রে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আধানে পরিণত হতে দেখা যায় । এই যেমন অক্সিজেন ।
তো জারণ সংখ্যার সংজ্ঞাটা হচ্ছে এরকম – কোন যৌগ গঠনের সময় একটি মৌল যতটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক বা ইলেকট্রন বর্জন করে ধনাত্মক আধানে পরিণত হয় তাকেই জারণ সংখ্যা বলে । এই যেমন জিঙ্ক বাবাজি প্রথমে নিষ্ক্রিয় ছিল । এরপরে সে ইলেকট্রন একটা ত্যাগ করে সালফেটের সাথে যুক্ত হয়ে, জিঙ্ক সালফেটে পরিণত হল । এই যে যৌগ গঠনের সময় জিঙ্ক একটি ইলেকট্রন বর্জন করেছে , তাই আমরা বলতে পারি জিঙ্কের জারণ সংখ্যা ধনাত্মক । এবং ইলেকট্রন ত্যাগ করেছে মাত্র একটি তাই জারণ সংখ্যা এক । এই হচ্ছে জারণ সংখ্যা । একই মৌলের জারণ সংখ্যা বিভিন্ন যৌগে বিভিন্ন হয় অর্থাৎ কোন একটি মৌল অন্য মৌলের সাথে যুক্ত হয়ে এক ধরনের বন্ধন গঠনে হয়ত ২ খানা ইলেকট্রন গ্রহণ করেছে । আবার দেখা গেল অন্য এক ধরনের বন্ধন ঘটনে সে ৩ টিই ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিল , তখন তার জারণ সংখ্যা হয়ে গেল ৩ । আর এই জারণ সংখ্যা ঋণাত্মক জারণ সংখ্যা । কারন এখানে ইলেকট্রন গ্রহণ করেছে ।
কোন যৌগের মাঝে বিভিন্ন মৌলের জারণ সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই । বা সূত্র নেই । যেমন ইহা হলে উহা হবে । এরকম কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই । তবে কতগুলো যুক্তি ব্যাবহার করা যেতে পারে । যেমন আমরা জানি পর্যায় সারণির গ্রুপ ১ এর ধাতু গুলকে বলা হয় ক্ষার ধাতু ।
আচ্ছা, পর্যায় সারণিতে যে আমরা পরে এসেছি – “পর্যায় সারণিতে গ্রুপের সংখ্যা আসলে ওই গ্রুপের পদার্থদের সর্ব বহিঃস্থ শক্তিস্তরে কয়টি ইলেকট্রন আছে সেটি প্রকাশ করে ” ।
এখন ক্ষার ধাতু সমূহ গ্রুপ ১ এ অবস্থান করছে । মানে এদের সবচাইতে বাহিরের শক্তিস্তরে একটি ইলেকট্রন আছে । বিক্রিয়ার সময় আমরা জানি যাদের বাহিরের শক্তি স্তরে কম ইলেকট্রন থাকে তারা ইলেকট্রন গ্রহণ করে আর যাদের বেশি ইলেকট্রন থাকে তারা আরও ইলেকট্রন গ্রহণ করে বাহিরের শক্তিস্তর পূর্ণ করে ।
ক্ষার ধাতু সমূহের বাহিরের শক্তিস্তরে একটা মাত্র ইলেকট্রন আছে । সে কি বন্ধন গঠনের সময় ইলেকট্রন দেবে না কি গ্রহণ করবে ?
দেবে । কারন একটা মাত্রই তো ইলেকট্রন আছে । তো সেটা কি দিয়ে দেয়াই তো সুবিধা । বন্ধন গঠনের সময় যখন ক্ষার ধাতু গুলো একটি ইলেকট্রন দিয়ে দেবে তখন আমরা বলব তার জারণ সংখ্যা ১ । কারন একটি ইলেকট্রন দিয়েছে । আর যেহেতু ইলেকট্রন দিয়েছে বা বর্জন করেছে তাই জারণ সংখ্যা ধনাত্মকে আছে । অর্থাৎ ক্ষার ধাতু গুলো যখন কোন যৌগের মাঝে অবস্থান করে তখন তার জারণ সংখ্যা হয় সাধারণত ১ । এবং জারণ সংখ্যা হয় ধনাত্মক । তবে নিষ্ক্রিয় অবস্থা সমস্ত মৌল এবং যৌগ সবারই জারণ সংখ্যা ০ । শুন্য ।
এরকম করেই বইয়ে কিছু যুক্তি রয়েছে যৌগে বিভিন্ন মৌলের জারণ সংখ্যা বের করার ক্ষেত্রে ।
একটা মজার বিক্রিয়া দিয়ে শেষ করি –
NaOH + HCl = NaCl + H2O …………………(2)
এই বিক্রিয়ায় NaOH এ Na+ এবং OH- । এরপরে HCl এ H+ আকারে এবং Cl- হিসেবে আছে ।
তারপরে এই দুইটা বিক্রিয়ক বিক্রিয়া করে যখন NaCl এবং H2O উৎপন্ন করে সেখানে ,
NaCl এ Na+ এবং Cl- হিসেবে আছে । আবার H2O এ H+ আকারে এবং OH- হিসেবে রয়েছে । এখানে কারই জারণ সংখ্যার পরিবর্তন হয় নাই যৌগ ভাঙ্গার এবং গঠনের সময় । জারণ সংখ্যার পরিবর্তন হয় নাই , এর অর্থ হচ্ছে এদের মাঝে কোন ইলেকট্রন গ্রহণ বর্জন হয় নাই , শুধু মাত্র ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানদ্বয় তাদের আগের বন্ধুন ভেঙ্গে নতুন বন্ধন তৈরি করেছে । কিন্তু কোন ইলেকট্রনের বিনিময় করে নি । তাই এটি জারন-বিজারন বিক্রিয়া নয় ।
আমরা (1) নং জারন-বিজারন বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি প্রথমে জিঙ্কের জারণ সংখ্যা ছিল শুন্য । তারপরে সে একটি ইলেকট্রন বাদ দিয়ে ধনাত্মক ১ জারণ সংখ্যা লাভ করল । অন্য দিকে কপারের জারণ সংখ্যা ছিল ধনাত্মক ১ , সেখান থেকে সে একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করায় তার জারণ সংখ্যা শুন্য হয়ে গেল ।
দুই নাম্বার বিক্রিয়াটি জারণ –বিজারণ বিক্রিয়া ছিল না । কারন সেখানে বিক্রিয়ক আর উৎপাদে মৌল সমূহের জারণ সংখ্যার হিসেব করে দেখা যায় কোন মৌল এরই জারণ সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয়নি । তাই ২ নাম্বার বিক্রিয়াটি জারণ বিজারণ বিক্রিয়া নয় ।
জাবের ইবনে তাহের

0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন